You are currently viewing তাবুতে সাকিনা ও একটি গবেষণা।দ্বিতীয়  ও শেষ পর্ব।

তাবুতে সাকিনা ও একটি গবেষণা।দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

আরবিতে এবং কুরআনের ভাষায়- ‘তাবুত’। রহস্যময় এই সিন্দুকের ব্যাপারে মুসলিম, ইহুদি, খৃস্টান- তিনটি ধর্মের অনুসারীরাই একমত যে, এ সিন্দুকটির অস্তিত্ব আছে এবং এটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। আল্লাহর পক্ষ থেকে রহস্যময় এ সিন্দুকটি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে প্রদান করেছিলেন তাদের নবি হজরত মুসা [আ.]। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় আছে সেই রহস্যময় অলৌকিক সিন্দুক? কেন তাকে হাজার বছর ধরেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? প্রতি শতাব্দীতে হাজারও রহস্যভেদী মানুষ সেই সিন্দুকটির খোঁজ করেছেন, কিন্তু পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। এখনও একদল রহস্যসন্ধানী লোক সিন্দুকটি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে নবি মুসার মৃত্যুর পর তার সান্নিধ্যধন্য নবি ইউশা ইবনে নুন সিন্দুকটির তত্ত্বাবধান করতেন। তার মৃত্যুর পর বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের পুরোহিতগণ এটি দেখাশোনা করতেন। কেননা এই সিন্দুকের অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো বলে তারা বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো, এই সিন্দুক সঙ্গে থাকলে কেউ তাদের পরাজিত করতে পারবে না এবং তারা সবার ওপর বিজয় অর্জন করবে।

বেশ কিছু বছর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় সিন্দুকটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা সিন্দুকটি নিয়ে বিপাকে পড়ে। কেননা যেখানেই সেটি রাখা হতো তার আশেপাশের লোকজনের মধ্যে মহামারী প্লেগ ছড়িয়ে পড়তো। এভাবে বেশ কিছুদিন তারা সিন্দুকটিকে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করে, একই ফল পাওয়া যায়। অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। উপায়ন্তর না দেখে তারা সিন্দুকটিকে একটি গরুর গাড়িতে করে অজানার উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। এরপর এটি বাদশাহ তালুতের হস্তগত হয়। তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। কুরআনে তার এবং সিন্দুকটির বর্ণনা এসেছে-

**বনি-ইসরাইলদেরকে তাদের নবি আরো বললেন,তালুতের নেতৃত্বের চিহ্ন হলো এই যে, তোমাদের কাছে একটা সিন্দুক আসবে যাতে থাকবে তোমাদের পালকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের মনের প্রশান্তি, আর তাতে থাকবে মুসা, হারুন এবং তাঁদের সন্তানবর্গের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বয়ে আনবে ফেরেশতারা। তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তাহলে এতে তোমাদের জন্য নিশ্চিতই পরিপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২৪৮)

এরপর সিন্দুকটি হজরত দাউদ [আ.]-এর হাতে আসে এবং তিনি তার পুত্র হজরত সোলায়মান [আ.]-কে এর তত্ত্বাবধানকারী নিযুক্ত করেন। হজরত সোলায়মান [আ.] আল্লাহর নির্দেশে জেরুসালেমে তার উপাসনালয় নির্মাণের সময় তাতে সিন্দুকটি স্থাপন করেন এবং সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেন। তার মৃত্যুর অনেক বছর পর ব্যাবিলনীয়রা জেরুসালেম দখল করে নেয় এবং তার উপাসনালয়টি ধ্বংস করে দেয়।

এরপর থেকে সিন্দুকটির সঠিক অবস্থান আর জানা যায়নি। কিছু ইতিহাসগ্রন্থের ভাষ্য অনুযায়ী, ব্যাবিলনীয়রা জেরুসালেমের অন্যান্য সম্পদের সাথে সিন্দুকটিও নিয়ে যায়। কেউ বলছেন, ওই সময় আল্লাহর আদেশে সিন্দুকটি বেহেশতে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর সিন্দুকটির অবস্থান সম্পর্কে অনেক গুজব শোনা যায়। শোনা যায়, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সময় ইউরোপিয়ান নাইট টেম্পলার যোদ্ধারা সিন্দুকটি জেরুসালেম থেকে পুনরুদ্ধার করে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ মত দেন, এটি ইউথিওপিয়ার অর্থোডক্স চার্চে সুরক্ষিত আছে। কারো কারো মতে, এটি ভ্যাটিকান চার্চের গোপন কুঠুরিতে সুরক্ষিত আছে। কিন্তু এসবই গুজব যার কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর সিন্দুকটিও পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় বস্তু হিসেবেই মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে।

পেন্টাটিউক অনুসারে সিনাই পর্বতে টানা ৪০ দিন থাকার পর সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নবী মুসা (আঃ) এই আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্ট নির্মাণের নির্দেশ পান। প্যালেস্টাইনে তৈরি হওয়ার কারণে আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্টকে ইসরায়েলের সৌন্দর্য নামেও অভিহিত করা হয়। পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে, সিন্দুকটি ঈশ্বরের নির্দেশেই বানানো হয়েছিল।

গঠনগত বৈশিষ্ট্য:

এটি লোহার তৈরি কোনো সিন্দুক নয়। মিসরের ‘একাসিয়া’ নামক একটি পবিত্র গাছের কাঠ দিয়ে সিন্দুকটি তৈরি করা হয়েছে। কাঠ দিয়ে তৈরি করা হলেও সোনা দিয়ে সিন্দুকটি মোড়ানো হয়। সিন্দুকটি লম্বায় ১.১৫ মিটার, প্রস্থে ০.৭ মিটার আর উচ্চতায় ০.৭ মিটার। এটি বহন করার জন্য রয়েছে দুটি হাতল।

আধ্যাত্মিক ক্ষমতা:

নির্মাণের পর থেকে বহু বছর ইহুদিরা এটি তাদের কাছে সযত্নে রেখেছিল। ইহুদিরা যখন ’ল্যান্ড অব ক্যাননে’ এসে পৌছায়, তখন তাদের সেখানে আসার পথ দেখিয়েছিল এই সিন্দুকটি। বলা হয় এই সিন্দুকের কারণেই জর্ডান নদী দুই ভাগ হয়ে রাস্তা করে দিয়েছিল তাদের জন্য। মুসলমান ধর্মশাস্ত্রবিদদের মতে আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্টের ইতিহাস ইসলামের সাথে সবচেয়ে বেশী সংযুক্ত। পবিত্র আল কুরআনে এই বিষয়ে সূরা আল-বাকারাতে বর্ণনা করা হয়েছে।

কিন্তু কোথায় আছে এই সিন্দুক?

এই সিন্দুকটির অস্তিত্ব নিয়ে কারো মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই সিন্দুকটি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ খুঁজে পায় নি এই সিন্দুকটি। কোথায় আছে এই সিন্দুক? এই প্রশ্নটি সবার মনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কেউ এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে নি।

কারো কারো মতে, অমূল্য এই সিন্দুকটি ব্যবিলন সভ্যতার কাছেই রয়ে গেছে। কারো মতে, রাজা সলোমন সিন্দুকটির খারাপ ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পেরে নিজেই সিন্দুকটি ’ডেড সি’র কাছে কোনও একটি গুহায় সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। অপরদিকে লেম্বা সম্প্রদায়ের (দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে) লোকদের দাবি, তাদের পূর্বপুরুষরাই সিন্দুকটি বহন করে নিয়ে এসেছে। আর ইথিওপিয়ান খ্রিস্টানদের দাবি এই যে, সিন্দুকটি ইথিওপিয়ার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এরকম আরও অনেকে অনেক রকম দাবি করেছে। কিন্তু কোথাও এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি।

পাপীদের এর ধারে কাছে যাওয়া মানা।

সাম্প্রতিক সময়ে এই সিন্দুকটি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শোনা যায়। সিন্দুকটির নাকি প্রকৃত খোঁজও মিলেছে। কিন্তু কেউ সেভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চায় না। শোনা যায় কোনো পাপী ব্যক্তি সিন্দুকটি স্পর্শ করতে পারবে না। এমনকি দু চোখ মেলে সিন্দুকটির দিকে তাকাতেও পারবে না। তাহলে তার যথাযথ শাস্তি সে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পেয়ে যাবেন। তারপরও তাবৎ দুনিয়ার মানুষ সিন্দুকটি খোঁজার কাজ অব্যাহত রেখেছেন।তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে এসে থেমে নেই সেই প্রচার-প্রচারণা:

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে অনেকেই এই বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেবেন না। কিন্তু সেই সব তথ্য প্রযুক্তির বোদ্ধাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হাজার হাজার বছর পরও এ নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি নেই। রহস্যময় এই সিন্দুকটি নিয়ে প্রচার মাধ্যমের প্রচার প্রচারনা থেকেই বোঝা যায় এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ২০০৮ সালে ’চ্যানেল ফোর’ এ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে।বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এ নিয়ে প্রচার হয়েছে বহু তথ্যচিত্র। এই সিন্দুককে ঘিরে নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্রও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-১৯৫১ সালের ’ডেভিড এন্ড বাথশিবা’, ১৯৫৬ সালের ’দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’, ১৯৫৯ সালের ’সলোমন এন্ড শিবা’ ১৯৮৯ সালের ’ইন্ডিয়ানা জোনস এন্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’, ২০০৮ সালের ’ইন্ডিয়ানা জোনস এন্ড দ্য কিংডম অব দ্য ক্রিস্টাল স্কাল’, ২০১০ সালের ’মেগামাইন্ড’ প্রভৃতি।

সবকিছু ক্যালকুলেশন করে বুঝা যাচ্ছে অতিশীঘ্রই সিন্দুকটি আবার সবার সামনে আসবে। ইনশাআল্লাহ।

Leave a Reply