You are currently viewing উম্মে মাহ্জান,ইতিহাসের   নবি প্রেমি এক সন্মানিত  নারী সাহাবি। আখিরুজ্জামান

উম্মে মাহ্জান,ইতিহাসের নবি প্রেমি এক সন্মানিত নারী সাহাবি। আখিরুজ্জামান

তিনি ছিলেন শুকনো -পাতলা ও দুর্বল শরীরের একজন কালো আফ্রিকান নারী। বাহির থেকে দেখে অনেকেই তাঁকে সেই সন্মান দেয়নি কিন্তু নবী মোহাম্মদ (সাঃ) মানুষের অন্তর দেখতেন ,তাই দেখে এই নারীকে যে সন্মান দিয়েছিলেন তা নিয়েই এই গল্প ।

তাঁর নাম উম্মে মাহ্জান।

হজরত আয়েশা (রাঃ) প্রায়ই তাঁকে দেখতে যেতেন ,খুব হাসি খুশি সহজ সরল এক নারী। সব সময়ই তাঁর মুখে হাসি লেগে থাকতো। আয়েশা (রাঃ) বলেছেন ,

-আমি যতবার উম্মে মাহ্জান কে দেখেছি ,প্রতিবারই সে আমাকে হাসি মুখে দুই লাইন কবিতা শুনাতো। মাত্র দুই লাইন কবিতা কিন্তু আমার ভালো লাগতো। সেই কবিতার দুই লাইন ,

“যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলো তার ,সেই মূল্যবান চাদর।

সেদিনই জেনেছি ,খোদা আমায় করেছিলেন সমাদর”

আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোন এক অজানা কবির ,কবিতার দুই লাইন কিংবা মাহ্জানের গ্রামের কোন আঞ্চলিক গানের দুটো লাইন। আমি এই কবিতার কোন মানে জানতাম না কিন্তু মাহ্জানের চোখের দৃষ্টি ,ভালোবাসা আর আবেগ দেখে আমার মনে হতো  এই কবিতার যেন কোন একটা অর্থ আছে। মনে হলো এই কবিতার পিছনে কোন একটা গল্প আছে । কিন্তু তাঁকে কোনদিন  জিজ্ঞেস করা হয়নি ।একদিন তাঁর অনেক আবেগ দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম ,

-মাহ্জান ,এই কবিতার মানে কি ?এখানে কি বলা হয়েছে ?

-আমার কবিতা ,আমার নিজের কাহিনী। মৃদু হেসে মাহ্জানের উত্তর।

-দয়া করে আমাকে একটু বলবে সেই কথা ,আমি শুনতে চাই ।

মাহ্জান সুদূর মরুভূমির দিকে প্রথমে  উদাস দৃষ্টিতে একবার তাকালো। তারপর মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে  আয়েশা (রাঃ)কে বললো ,

-শুনেছি আমার জন্ম উত্তর ইথিওপিয়ার কোন এক গ্রামে ,বাবা -মা ,ভাই- বোন বলে আমার কেউ আছে বলে জানিনা। খুব ছোট বেলায় আমাকে কেউ একজন শহরের বাজারে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয় ।সেই  থেকে আমি আবিসিনিয়ার এক ধনী ব্যবসায়ীর ক্রীতদাসী হিসেবে বড় হয়েছি। আমি তাঁর একমাত্র মেয়েকে দেখাশুনা করে রাখতাম। আমার কাছে সে ছিল রাজকন্যার মত। সে খুব দামী সুন্দর জামা কাপড় পরে থাকতো। একদিন সেই রাজকন্যা   ঘরের পিছনের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিলেন ,তাঁর গায়ের উপর ছিল একটা সুন্দর দামী মনি মুক্তা খচিত মেরুন রঙের চাদর। হঠাৎ আমি দূর থেকে দেখি একটা বড় বাজ পাখি এসে রাজকন্যার গায়ের চাদরটা তুলে নিয়ে চলে গেলো। আমি কাছে এসে দেখি রাজকন্যা তখনো ঘুমাচ্ছেন।

ঘুম ভাঙার পর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,

-আমার গায়ের চাদর কোথায় মাহ্জান ?

-একটা পাখি নিয়ে গেছে ,আমি ভয়ে ভয়ে বললাম।

-পাখি নিয়ে গেছে মানে ?তুমি কি আমাকে বোকা মনে করছো ?

-না ,সত্যি বলছি ,আমি নিজের চোখে দেখেছি।

কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না ,আমাকে তাঁর বাবার কাছে নিয়ে গেলেন । তিনি আমার কথা শুনে আরো রেগে গেলেন । মানুষজনকে ডেকে এনে আমাকে আরো অপমানিত করলেন । সবার ধারণা হলো আমিই সেই মূল্যবান চাদর চুরি করেছি এবং কোথাও লুকিয়ে রেখেছি। আমার সব কিছু তল্লাশি করা হলো তারপর আমাকে বারন্দায় একটা খুঁটিতে বেঁধে খুব জোরে চাবুক পেটা করা হলো। আমি যতই বলি আমি চুরি করিনি ততই তারা আমাকে আরো মারলো ,আমার সারা গা থেকে রক্ত ঝরছিলো। মারতে মারতে আমাকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলা হলো ঠিক সেই সময়ে আমি দেখলাম ,সেই বাজ পাখিটা চাদরটাকে ঠোঁটে করে নিয়ে এসে সকলের সামনে ,একটু  উপর থেকে চাদরটাকে নীচে ফেলে দিলো। সবাই দেখলো এবং অবশেষে আমার কথা তাঁরা  বিশ্বাস করলো।

তারপর খুঁটি থেকে আমাকে মুক্ত করা হলো কিন্তু আমার দাঁড়ানোর মত কোন শক্তি ছিল না। সারা গায়ে রক্ত আর ব্যথা নিয়ে আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম। আমার এই অবস্থা দেখে মনিবের একটু মায়া হলো এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো ,

-তোমাকে চীরদিনের জন্য মুক্ত করে দিলাম মাহ্জান ,তুমি আর ক্রীতদাসী নও ,তুমি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারো।

সেইদিনই  আমি মুক্ত হয়ে গেলাম ,আমি আমার সব ব্যথা বেদনা ভুলে গেলাম ,আকাশের দিকে তাঁকিয়ে খোদা তায়ালাকে শুকরিয়া জানালাম।

মুক্ত হলাম ঠিকই কিন্তু কোথায় যাবো ?আমারতো নিজের বলে কেউ নেই। আমার এই দুর্বল ও হালকা দেহে ভারী কোন কাজও করতে পারছিলামনা। তারপর একদিন মানুষের কাছে শুনলাম ,মদিনায় একজন নবী এসেছেন তিনি ক্রীতদাস-দাসীদের সন্মান দেন ,তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। একদিন মনে হলো তাঁর কাছে চলে আসি এবং রওয়ানা দিয়ে দিলাম  মরুভূমির এই দীর্ঘ পথ। কখনো হেঁটে ,কখনো উটে করে অবশেষে পাড়ি দিয়ে নবীজির কাছে এসে পৌঁছলাম। ভিনদেশি আমার দিকে সবাই অবাক হয়ে তাঁকিয়েছে কিন্তু মনে হলো তিনি যেন আমার সব কাহিনী জানেন ।আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

-তুমি কোথায় থাকবে মাহ্জান ?মদিনায় কেউ কি তোমার আছে ?

-না ,আল্লাহর রাসূল ,আমার কেউ নেই।

-আচ্ছা ঠিক আছে ,চিন্তা করোনা ,আমি তোমাকে আমার মসজিদের একটা কোনায় খেজুরের ডালপালা দিয়ে একটা ছোট ছাউনি তুলে দিবো ,তুমি সেখানেই থাকবে।

সেই থেকে আমি এই মসজিদের কোনায় থাকি। আমাকে তিনি কোন কাজের কথা বলেন নি কিন্তু আমি দিনের বেলা মনুষের কাজ করি আর রোজ রাতে আল্লাহর এই ঘরকে পরিষ্কার পরিছন্ন করি । এই কাজের জন্য আমি আল্লাহ আর তাঁর রাসূলের ভালোবাসা ছাড়া আর কোন বিনিময় চাইনা।

এই গল্প শুনে আয়েশা (রাঃ) নীরবে অশ্রুপাত করলেন ,ভালোবেসে আর আদরে মাহ্জানকে একটু জড়িয়ে রাখলেন।

শেষ অংশ :

তারপর কোন এক রাতে সাহাবীরা জানতে পারলেন উম্মে মাহ্জান মারা গিয়েছেন ।এক নিঃস্ব অসহায় কালো আফ্রিকান নারী ,মসজিদে নবীবির প্রথম ক্লিনার আর নেই।

তাঁরা ভাবলেন এই রাতের বেলা রাসূল (সাঃ) কে আর ঘুম থেকে তুলে কষ্ট দেয়ার প্রয়োজন নেই তাই নিজেরাই রাতের বেলা জানাজা শেষে দাফন করে ফেললেন ।

ভোর বেলা রাসূল (সাঃ) যখন এই খবর শুনলেন তিনি খুব অভিমান করলেন ,সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন

-আমাকে কেন তোমরা ডাকোনি ?আমি তাঁর জানাজায় অংশগ্রহন করতাম।

তাঁরপর তিনি সবাইকে বললেন ,

-মাহ্জানের জানাজা আবার হবে ,আমাকে তাঁর কবরের কাছে নিয়ে যাও।

দ্বিতীয় জানাজা হলো ,নবীজি সা: ইমামতি করলেন। তারপর আকাশের দিকে হাত তুলে মাহ্জানের জন্য দীর্ঘক্ষণ দোয়া করলেন।

রাসূল (সাঃ)এর জীবনে উম্মে মাহ্জানই একমাত্র মানুষ যাঁর জন্য দুইবার জানাজা হয়েছিল।

সেই সময়ে দুইবার জানাজা আর কারো জন্য হয়নি ,এই ছিল তাঁর প্রাপ্তি ,অসাধারন এই নারীর প্রতি বিশেষ  সন্মান ।

(গল্প সূত্র :সীরাত ইবনে সা’আদ ও বোখারী-মুসলিম )

Leave a Reply